বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাল-সেকাল।

২২শে ডিসেম্বর, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)- এর
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯২১ সালের এ দিনে বুটেক্স
, ব্রিটিশ
স্কুল অব উইভিং নামে যাত্রা শুরু করে। তারপর পূর্ব বাংলা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট
,
পূর্ব পাকিস্তান টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, কলেজ
অব টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলোজি এবং সর্বশেষ বুটেক্স বা বাংলাদেশ
টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় নাম ধারন করে প্রতিষ্ঠানটি স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। তবে এ
প্রতিষ্ঠানটি পূর্ববাংলায় গড়ে উঠার ইতিহাস আরও পুরোনো।

এ অঞ্চলে বস্ত্রশিল্প গড়ে
উঠেছে হাজার হাজার বছর আগে
, আর এ অঞ্চলের বস্ত্র পৃথিবী
জুড়েই বিখ্যাত ছিলো। ঐ সময়কার মসলিনের নাম আজও আমরা জানি এবং মসলিনের একটি
ডিরাইভেটিভ (
derivative) হিসেবে জামদানি আজও টিকে আছে।
এখানে মসলিন উৎপাদনের জন্য যে তুলা প্রয়োজন ছিলো তাও এখানেই উৎপাদিত হতো। ১৮২০
সালে যখন শিল্পবিপ্লব শুরু হলো তখন ইংরেজরা মসলিনের উপর ৮০% কর আরোপ করলো যেনো
ইউরোপের বাজারে বাংলার মসলিন বা অন্যান্য বস্ত্র না ঢুকতে পারে। তারা বাঙালি তুলা
চাষীদের দিয়ে নীল চাষ করিয়েছিলো আর নিজেদের দেশের উৎপাদিত বস্ত্র দিয়ে প্রথম
শিল্পবিপ্লব সংগঠিত করেছিলো। যাইহোক এই ভঙ্গুর বস্ত্রশিল্প আর পাটশিল্পকে উজ্জীবিত
রাখতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িক ব্রিটিশ উইভিং স্কুল নামে
নারিন্দায় এ প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়।

 বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

British Weaving School [1921-1935]
👇
East Bengal Textile Institute [1935-1950]
👇
East Pakistan Textile Institute [1950-1978]
👇
College of Textile Engineering and Technology [1978-2010]
👇
Bangladesh University of Textiles, BUTEX [2010-Contd…]

BUTEX

নারিন্দা থেকে
তেঁজগাওয়ে জমি লিজ নেয়া এবং তা স্থায়ী করার পেছনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অবদান
ছিলো। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের শিল্পমন্ত্রী থাকার সময় তেঁজগাওয়ে জমি
পাওয়ার জন্য এককভাবে প্রচেষ্টা করেন এবং সম্ভবত ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠানটি
 বর্তমানে যেখানে
অবস্থিত
, এই জমিটি লিজ হিসেবে পায়। তারপর ১৯৭২ সালেও বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় লিজ
হিসেবে নেয়া জমিটি স্থায়িত্ব লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর এ সম্পৃক্ততার বিষয়টি
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ শিক্ষকের কাছ থেকে শোনা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো
উইকিপিডিয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের কোনো জায়গায় কি এক অজানা কারণে
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পুরো ইতিহাসটি রচিত হয়নি।

 প্রায় একশো বছরের
পুরোনো ইতিহাস বুটেক্সের। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে এর অবস্থান কোথায়
? কোনো সন্দেহ নেই প্রাইভেট সেক্টরে হাজার হাজার টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ার সরবরাহ
করেছে প্রতিষ্ঠানটি
, কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারিভাবে কেনো একটি পোস্টও
থাকবে না টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারদের জন্য
? আমরা আমাদের দেশী তাঁত
শিল্পের কথা আসলেই বলি প্রতিযোগীতায় টিকতে না পেরে তাঁত ধ্বংস হয়ে গেছে। পাটের কথা
আসলে বলি প্রতিযোগীতায় টিকতে না পেরে পাট ধ্বংস হয়ে গেছে। সেদিনও বেশী দেরী নেই
যখন আমরা বলবো প্রতিযোগীতায় না পেরে গার্মেন্টসের লোকাল মার্কেট ধ্বংস হয়ে গেছে। 
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। বাংলাদেশের লোকাল বাজারে ইউনিকলো (UNIQLO), ডিকাথলন (DECATHLON), পুমা (PUMA) -সহ আরও নানা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড সবে মাত্র প্রবেশ করেছে। তারা যে কোয়ালিটি এবং
বাজার দর মেনে চলে সে কোয়ালিটি কি নিউমার্কেট বা লোকাল বাজারের ব্যাবসায়ীরা রক্ষা
করতে পারবে
?
 উত্তর হচ্ছে “না”। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো যখন এদেশের বাজারকে
পুরোপুরিভাবে বুঝে যাবে তখন তাদের দেশীয় বাজারকে দখল করতে বেশীদিন লাগবে না। এখন
তাদের সাথে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রোডাক্ট কোয়ালিটি বৃদ্ধি
করতে হবে এবং এর জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং জনগণকে বোঝাতে হবে। দেশীয় এ
বাজার ধরে রাখতে হলে সরকারের অবশ্যই নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে টেক্সটাইল
ইন্জিনিয়ারদের প্রয়োজন
, দেশীয় বাজার রক্ষায় কোয়ালিটি এবং বাজার দর
নিয়ন্ত্রণ বেসরকারিভাবে বা টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারদের বাইরের কারও
  পক্ষে সম্ভব না। একইভাবে সরকারের কাস্টমস, অডিট এবং বস্ত্র
মন্ত্রণালয়েও টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেয়া জরুরি। কিন্তু অপ্রিয় সত্য কথা
হলো সরকার এখনো এ প্রয়োজণীয়তা অনুভব করেনি
 কিংবা বস্ত্র প্রকৌশলীদের দিক থেকে বোঝাতে সক্ষম
হয়নি

একটি গার্মেন্টস
প্রোডাক্টের বিক্রয় মূল্য ১০০ টাকা হলে সাধারণভাবে এর ক্রয়মূল্য ১০০ এর তিনভাগের
একভাগ অর্থাৎ ৩০ টাকার মতো হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ সেই প্রোডাক্টটি বিক্রি করে ৩০
টাকায়। এই ত্রিশ টাকার প্রায় অর্ধেক ব্যায় হয় কাঁচামাল
 (raw materials) আর একসেসরিস (accessories) আমদানিতে। অর্থাৎ ১০০
টাকার প্রোডাক্টের
 মাত্র ১৫ টাকায় বাংলাদেশের লাভের অংশ থাকে এবং তাতেই বাংলাদেশের ৮০ ভাগ অর্থনীতি
চলে
, বাদবাকি ৮৫ টাকায় থাকে বিদেশি বায়ার ও সাপ্লায়ারের অংশ। শুধু শ্রমিকের
সস্তা শ্রমের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ যে ১৫% ব্যাবসা করে তা পুরোটাই নির্ভর করে
বিদেশী বায়ার আর ভারত এবং চায়নার তুলা ও সুতা ব্যাবসায়ীদের মর্জির উপর। এ জায়গা
থেকে বের হয়ে টেকসই শিল্প গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই কাঁচামাল উৎপাদন এবং নিজেদের
অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে তাকাতে হবে এবং এর জন্য সরকারের নীতি
নির্ধারণী পর্যায়ে অবশ্যই টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ার প্রয়োজন।  

 সরকারকে এ বিষয়গুলো
অনুভব করানোর দায়িত্ব যাদের
, আইবি, আইটিইটি ও অন্যান্য
পেশাজীবী সংগঠন
, তারা ১০ বছর আগে নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলো টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারদের জন্য টেক্সটাইল ক্যাডার সার্ভিস নিয়ে আসা হচ্ছে।
আজ দশ বছর পর আইটিইটির নির্বাচন গেলো আসলো
, আইবির নির্বাচন গেলো
আসলো
, এবং তারপরের ঘটনা হলো এই যে, বিপিএসসির ওয়েবসাইটে
বিশ্ববিদ্যালয় চয়েজ লিস্টে ১৬০ টি সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫৯ টির
নাম আছে
, কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নাই, সেটি হলো বাংলাদেশ
টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। আর হাজার খানেক সাবজেক্টের মধ্যে কেবল একটি সাবজেক্টের
নাম নাই
, সেটি হলো টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং (টেক্সটাইল টেকনোলজি নামে আছে, টেকনোলোজি আর ইন্জিনিয়ারিং এক বিষয় নয়)। যেখানে চয়েজ লিস্টেই বিশ্ববিদ্যালয়
কিংবা সাবজেক্টের নাম নাই সেখানে আবার কেডার সার্ভিস!!! জানিনা ১০ বছরের পর আর কত
বছর গেলে নির্বাচনের আগে দেওয়া সেই আশ্বাসকে মিথ্যা আশ্বাস বলা যাবে!! এই হলো
প্রায় একশো বছর আগে প্রতিষ্ঠা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আইডিন্টিটি
ক্রাইসিসের এক প্রকার নমুনা যার উদাহরণ আরও দশখানা দেওয়া যাবে। তবে সেই সব ভুলেই বলতে
চাই “শুভ জন্মদিন প্রাণের বুটেক্স”।।

 কার্টেসিঃ ইঞ্জিনিয়ার ফয়সাল
রিশাদ।

Texpedi.com

Leave a Comment