প্রকাশনার জগতে “প্রিডেটরি পাবলিশিং” বলে
একটা কথা আছে। এই জাতীয় প্রকাশনাকে “প্রতারণামূলক প্রকাশনা“ও বলা হয়ে থাকে। ছাপার অক্ষরে কোন কিছু ছাপা হলেই তা মূল্যবান হয় না। বহু
অখাদ্য, কুখাদ্য আছে যা ছাপার অক্ষরে ছাপা হয়। প্রিডেটরি পাবলিশিং হল এমন
এক ধরণের প্রকাশনা যা, বুদ্ধিভিত্তিক অবদানের চেয়ে
ব্যবসায়িক মুনাফা ও স্বার্থকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে সেট করে নেয়। এই জাতীয়
পাবলিশিং হাউজগুলি কেবল টাকার বিনিময়ে কোন বই, বইয়ের চ্যাপ্টার, জার্নাল আর্টিকেল প্রভৃতি ছেপে দেয় এগুলির একাডেমিক বা ইন্টেলেকচুয়াল কোন
রকম চেক, গুরুত্ব বা যথার্থতা
নিরীক্ষণ করা ছাড়াই। বিষয়টা এমন যে, টাকা দাও, ছেপে দেই।
একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে কোন কিছু পাবলিশ করতে হলে, সেটা বুক হোক, বুক চ্যাপ্টার হোক, বা জার্নাল আর্টিকেল হোক, পিয়ার রিভিউ হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একাধিক স্কলারদের দ্বারা এইসবের
যাচাইবাচাই হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, পর্যালোচনা হয়। কখনো কখনো দু‘জন রিভিউয়ার ভিন্ন ভিন্ন মত দিলে তৃতীয়, চতুর্থ, এমনকি দরকার পড়লে পঞ্চম একজন রিভিউয়ারকে দিয়ে তা রিভিউ করা হয়। যখন এই
স্কলার কাম রিভিউয়াররা ইতিবাচক মত দেন যে, সংশ্লিষ্ট ম্যানাস্ক্রিপ্টটি/সমুহ একাডেমিক্যালি কোয়ালিটিফুল বা
সিগ্নিফিকেন্ট এবং ছাপানোর যোগ্য, কেবল তখন তা ছাপা হবে। কিন্তু প্রিডেটরি কোন প্রকাশনা এই রিগোরাস রিভিউ
প্রসেসের ধাঁর ধারে না। তাঁদেরকে টাকা দিলেই কোন রকম রিভিউ ছাড়া পাবলিশ করে দেয়।
বলে রাখা ভাল যে, টাকা দিয়ে পাবলিশ করা মানেই পাবলিকেশনটি খারাপ তা বলা যাবে না।
বহু নামকরা এবং স্বীকৃত পাবলিশার আছে (জার্নাল বা বুক পাবলিশার), যারা আর্টিকেল/বুক প্রসেসিং চার্জ (এপিসি) নিয়ে ওপেন এক্সেস
পাবলিশ করে এবং সাথে সাথে এই রিগোরাস রিভিউ প্রসেস এনশিউর করে। অর্থাৎ, রিভিউয়াররা গ্রীন সিগনাল দিলেই কেবল এপিসি নেয় এবং পাবলিশ করে
(এগুলি প্রিডেটরি প্রকাশনার মধ্যে পড়বে না)। মূল কথা হল, এই রিভিউ প্রসেস। কিন্তু প্রিডেটরি পাবলিকেশন রিভিউ প্রসেস ফলো
না করে কেবল টাকার বিনিময়ে ছাপানোর কাজ করে। একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে এই জাতীর
প্রিডেটরি প্রকাশনাকে তুচ্ছ করে দেখা হয়।
আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি বেল (Jeffrey Beall) এই জাতীয়
প্রিডেটরি পাবলিশিং এর একটা লিস্ট তৈরি করেছেন, যা Beall’s List of Predatory Journals and Publishers নামে পরিচিত। এই লিস্ট নিয়ে নানান কথা থাকলেও একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে তা গুরুত্বসহকারে দেখা
হয়। এই লিস্ট থেকে প্রিডেটরি জার্নাল ও পাবলিশার সম্পর্কে জানা যাবে। এবার আসি আসল কথায়। “প্রিডেটরি জার্নালগুলি একটার পর একটা ই-মেইল পাঠায় এডিটোরিয়াল
বোর্ড মেম্বর কিংবা রিভিউয়ার হওয়ার অফার দিয়ে। আমি যদ্দুর জানি, কোন স্বীকৃত জার্নালের এডিটর কিংবা দায়িত্বশীল কেউ এই কায়দায়
সংশ্লিষ্ট জার্নালের এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বর হওয়ার জন্য অফার দেয় না। এমনকি
আর্টিকেল চেয়ে অনুরোধ বা অনুনয়/বিনয় করে না।
জার্নালের
ইম্প্যাক্ট ফ্যাকটর (আইএফ) নিয়েও কথা আছে। বহু প্রিডেটরি জার্নাল আছে যেগুলি হাই
আইএফ দেখায়। কিভাবে তাঁরা এর হিসেব করে আল্লাহ্ মালুম। একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বহু সংস্থা আছে যাঁদের এবস্ট্রাক্টটেড এবং ইন্ডেক্সড
জার্নালগুলি একাডেমিক্যালি রেকগ্নাইজড। বিশেষ করে সোশ্যাল সাইন্স এর ক্ষেত্রে বলা
যায়, সোশ্যাল সাইন্স সাইটেশন
ইন্ডেক্স, আর্টস এন্ড হিউমানিটিস
সাইটেশন ইন্ডেক্স, স্কোপাস, এমার্জিং সোর্সেস সাইটেশন ইন্ডেক্সড জার্নালগুলি নিঃসন্দেহে মানসম্মত। পাবলিশারের কথা বললে, নামকরা পাবলিশারসমূহ যেমন টেলর এন্ড ফ্রান্সিস/রাউটলেজ, উইলি এন্ড সন্স, স্প্রিঙ্গার, সেজ, এলসেভিয়ার‘সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস
কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই জাতীয় কোন জার্নাল থেকে
এভাবে এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বর হওয়ার কোন অফার দেয় বলে জানা নেই।
আমি
এই জাতীয় অফারসম্বলিত ই-মেইল প্রায়ই পাই। আপনারাও নিশ্চয়ই পেয়ে থাকবেন। প্রায়ই
আবার আমার/আমাদের প্রকাশিত কোন আর্টিকেলের রেফারেন্স/এমনকি এবস্ট্রাক্ট কপিপেস্ট
করে দিয়ে প্রশংসাসুচক কথাবার্তা বলা থাকে। আপনি এই ফিল্ডের একজন অথরিটি, অমুক, তমুক, আপনার এই আর্টিকেলটি আমি/আমরা পড়েছি, দারুণ অবদান রাখছেন আপনি
একজন স্কলার হিসেবে–এইসব ফালতু টাইপের প্রশংসাবাণী প্রায়ই দেখা যায়। এতে যদি কেউ
গলে যান, আমার মনে হয় নিজের ক্ষতি করে
ফেলবেন। বিশেষ করে ইয়াং সহকর্মীদেরকে সবিনয়ে বলছি।
কোন
পেপার পাবলিশ করার ক্ষেত্রে আমার প্রফেসর আমাকে বলেছেন, কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটি একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে ইম্পরট্যান্ট। যেনতেন
জার্নালে/প্রিডেটরি জার্নালে ৫০ টা পেপার পাবলিশ করার চেয়ে স্বীকৃত জার্নালে ৫ টা
পাবলিশ করা উত্তম। তাছাড়া, আপনার কোন একটা পেপার একটা
প্রিডেটরি জার্নালে পাবলিশ হলে একাডেমিক ওয়ার্ল্ডের ন্যূনতম খোঁজখবর যারা রাখেন
তাঁরা কিন্তু আপনার সম্পর্কে একটা খারাপ ইম্প্রেশন নিয়ে নিবেন। আপনার একাডেমিক
হাইট এবং কোয়ালিটি সম্পর্কে সাথে সাথে একটা নিচু ধারণা নিয়ে নিবেন। এই বিষয়টা খুব
গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক
তেমনি, কোন একটা
প্রিডেটরি/যেনতেনভাবে প্রকাশিত কেবল ব্যবসায়িক স্বার্থে পরিচালিত জার্নালে
এডিটরিয়াল বোর্ড মেম্বর হিসেবে আপনার নাম দেখলে ঐ একইভাবে আপনার সম্পর্কে একটা
খারাপ ধারণা গঠন করে ফেলবেন। কাজেই জার্নাল আর্টিকেল/বুক/বুক চ্যাপ্টার প্রকাশনার
ক্ষেত্রে যেমন জার্নাল বা প্রকাশকের মান এবং স্বীকৃতির বিষয়টা আমলে নেওয়া উচিৎ, ঠিক তেমনি কোন জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বর হওয়ার ক্ষেত্রেও
সংশ্লিষ্ট জার্নালের মান ও স্বীকৃতির ব্যাপারটা বিবেচনায় রাখা জরুরী।
তবে, আপনি যদি নিজেকে এই জাতীয় প্রিডেটরি জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বর
হয়ে মানুষকে দেখাতে বা বোঝাতে চান যে, আপনি একজন বড় স্কলার, তাইলে এইসব কথা যা এতক্ষণ বললাম তা অর্থহীন। এই জাতীয় কারো (যদি থাকে)
ক্ষেত্রে এই পোস্ট কোন কাজে আসবে না। একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে আপনাকে যথাযথভাবেই
মূল্যায়ন করা হবে। যারা বোঝার তাঁরা কিন্তু বুঝবে। আমি বলছি, বিশেষ করে নবীন এবং উদীয়মান কোন স্কলার যেন ফাঁদে পা না দেন না বুঝে। ধারণা
না থাকলে এ ক্ষেত্রে আপনার পাশের যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ কিংবা একাডেমিক্যালি অগ্রসরমান
বা এমনকি দূরের পরিচিত কোন স্কলার, তাঁকে কন্সাল্ট করা যেতে
পারে। তাঁর পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঝে মাঝে এই প্র্যাকটিসটা
করে থাকি।
প্রিডেটরি
পাবলিকেশন থেকে, তা জার্নাল আর্টিকেল হোক, বুক হোক, বা বুক চ্যাপ্টার হোক, সাবধানে থাকুন।
You may like also: