বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের ইতিহাস ও ধ্বংসের কারণ

বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের ইতিহাস ও ধ্বংসের কারণ | Cotton Fibres
In fiscal 2018-19, Bangladesh imported 6.9 million bales of cotton from the world to meet its demand. The country annually spends US$ 3.5 billion in importing cotton. Source: The Financial Express

ভি. আই. লেনিন তার “Imperialism,the highest of capitalism” গ্রন্থে বলেছেন পুঁজিবাদী সমাজে কোনো বিপর্যয়
কিংবা দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বড় এন্টারপ্রাইজগুলো একই সাথে পণ্যের কাঁচামালের মূল্য
এবং পণ্যের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে, ফলে যেসকল ছোট ও মধ্যম এন্টারপ্রাইজগুলো
ঐ পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত তারা পরে যায় বিপদে; অনেকসময় দেউলিয়াও হয়ে
যায়। উদাহরণস্বরূপ, সমগ্র গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল কিংবা গার্মেন্টসের বাজার
মূল্য কোনোটার সাথেই বাংলাদেশ জড়িত নয়, অর্থাৎ বাংলাদেশ কেবল গার্মেন্টস
প্রক্রিয়াজাতকরণ যেমন নিটিং, ডাইং, সুইং ইত্যাদি শ্রমনির্ভর কাজের সাথে জড়িত। ফলে
বিশ্ববাজারে গার্মেন্টসের কাঁচামাল যেমনঃ তুলার দাম বাড়িয়ে দিয়ে এবং গার্মেন্টসের বাজার
মূল্য কমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমের মূল্য অনায়াসেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা বর্তমান
কভিড মহামারীর সময়ে অনেকাংশেই ঘটেছে। এর ফলে দেশের গার্মেন্টস শিল্প এক মহা বিপদের
মধ্যে পড়েছে, শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে এবং দেশে বেকারত্বও অনেক
বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ কি গার্মেন্টস শিল্পে আজীবন শ্রম নির্ভর হয়েই থাকবে
নাকি টেকসই হবার জন্য কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করবে? কিংবা কারা কাঁচামাল আর
গার্মেন্টসের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে?

তুলা পৃথিবীর এক আদিম কৃষিজ পণ্য।
খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগেও মিশর, ভারত এবং দক্ষিণ আমেরিকার সভ্যতায়
তুলার তৈরি কাপড়ের হাদিস মেলে। বাংলাদেশে উৎপন্ন তুলা দিয়ে তৈরি মসলিন কাপড় রোমান
সাম্রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। বাংলাদেশের
  এ মসলিন ১৮০০
সাল পর্যন্ত আরব ও ইউরোপে রপ্তানি হতো। বাংলাদেশে উৎপাদিত তুলা যা দিয়ে মসলিন
বানানো হতো তার কাউন্ট ছিলো ৩০০ যা আজকের উন্নতমানের মেশিন দিয়ে বানানোর কথা
কল্পনাই করা যায় না। তাহলে যে দেশে এতো উন্নতমানের তুলা উৎপাদিত হতো তা হঠাৎ ধ্বংস
হলো কেনো? 

ইংরেজরা বাংলা দখল করে ১৭৫৭ সালে। আর ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়
১৭৮০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম পণ্য ছিলো গার্মেন্টস।
তাই ইউরোপের তৈরি গার্মেন্টস ছাড়া অন্য কোনো গার্মেন্টস যেনো বিশ্ব বাজারে প্রবেশ
না করে সেজন্য ইংরেজরা ঢাকাইয়া মসলিনের উপর ৮০% কর আরোপ করে। শুধু তাই নয়, ইংরেজরা
তাদের গার্মেন্টস শিল্প প্রসার করার জন্য এদেশের তুলা চাষীদের দিয়ে তুলার বদলে জোর
করে নীল চাষ করায়, তখনকার সময় ইউরোপীয় বস্ত্রে রংয়ের জন্য ব্যাপক চাহিদা ছিলো
এদেশের নীলের। অথচ নীল চাষীরা যোগ্য পারিশ্রমিকও পেতো না। এমনকি যারা মসলিনের
কারিগর ছিলো তাদের আঙুল পর্যন্ত কেটে ফেলা হতো। ফলে কয়েক দশকের মাঝেই এদেশ থেকে
তুলা ও মসলিন উভয়ই বিলুপ্ত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তুলার বাজার নিয়ন্ত্রণ
করছে পাশ্চাত্য আর নীল চাষীদের মতো সস্তা শ্রমের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
International Cotton Association কিংবা Best Cotton Initiative এর মতো
পাশ্চাত্যভিত্তিক সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী তুলার দাম নিয়ন্ত্রণ
  করছে। বিশ্বের প্রায় ৫০ ভাগ তুলা কেনাবেঁচা হয় এসকল
সংগঠনের মাধ্যমে।
শুধু কি তুলা? গার্মেন্টসের বড় বড়
ব্র্যান্ডগুলোও পাশ্চাত্যের দখলে। ফলে গার্মেন্টসের বাজার মূল্যও নিয়ন্ত্রণ করছে
পাশ্চাত্য। বাংলাদেশ নিজেই একটি বড় বাজার। অথচ বাংলাদেশের বাজার নিজেরা সংরক্ষণ না
করে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো এদেশ থেকে
সস্তা শ্রমে পোশাক কিনে এদেশেই বিক্রি করে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ তুলা
আমদানি করে সস্তা শ্রমে পোশাক বানাচ্ছে তারপর এগুলো কিনে এদেশেই বিক্রি করা হচ্ছে!



বাংলাদেশ গার্মেন্টস রপ্তানিতেদ্বিতীয় স্থানে থাকলেও চীন, ভারত ও ভিয়েতনামে এ শিল্প বাংলাদেশের চেয়ে টেকসই, কারন
তারা তুলা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর বাংলাদেশ তুলা আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়, এবং
বেশিরভাগ তুলা ভারত ও চীন থেকেই আমদানি করে থাকে। ফলে সমগ্র টেক্সটাইল শিল্প
বিবেচনা করলে বাংলাদেশ ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশ তার
চাহিদার মাত্র ২% তুলা এদেশে উৎপাদন করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ তুলা উৎপাদনে
পিছিয়ে থাকার পেছনে আরেকটি কারন হলো তুলা উৎপাদনের দীর্ঘ প্রক্রিয়াজাতকরণে কৃষকদের
অনীহা। এটি কিভাবে স্বল্প সময়ে করা যায় তা নিয়ে দেশের কৃষি ও টেক্সটাইল
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা করা উচিৎ। তা না হলে নব্য কলোনিয়াল দেশ হিসেবে পু্ঁজিবাদী
সমাজের অংশ হয়েও এদেশ কখনো পুঁজিপতি হয়ে উঠতে পারবে না, আজীবন শ্রম নির্ভর শিল্প
নিয়েই পথ চলতে হবে।

Courtesy:
Engr. Faisal Rishad
B.Sc. in Textile Engineering (BUTEX)

Texpedi.com

Leave a Comment